Monday, June 30, 2008

গ্রেফতারের পর নিজামী : শেষ পর্ব

মনসুর কাকা অতীতে ফিরে গেলেন। অন্ধকারের মহাউৎসবে মইত্যার সাথী তিনিও ছিলেন! ভুল, ভীষণ বড় ভুল। ইসলামের নামে যে পাপ তিনি করেছিলেন সেদিন, তার প্রায়শ্চিত্ত তিনি আজো করছেন। নেতা ছিল মইত্যা। নেতার কথামত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ করেছেন, ধরিয়ে দিয়েছেন। যেসব পরিবার থেকে যুবকরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করতে গেছে, সেসব পরিবারের যুবতী মেয়েদের ধরে ধরে পাকিস্তানী মিলিটারী ক্যাম্পে দিয়ে এসেছেন। প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিবাদ করেছিলেন। শত্রু সম্পত্তি ভোগ করা ইসলাম সম্মত এ কথা বলে তাকে বুঝ দেয়া হয়েছিল। মানুষ খুন, পাকিস্তানী মিলিটারিদের হাতে নিজের দেশের মানুষ ভোগের জন্য তুলে দিতে হাত কাঁপলেও ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার কথা ভেবে চুপ থেকেছেন। ইসলাম রক্ষায় নিরলস কাজ করে গেছে। মইত্যার নির্দেশ পালন করেছেন। ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় প্রায়ই সুনিশ্চিত মনে হচ্ছে। করণীয় কি? আল-বদর নেতা মইত্যা সবাইরে ডেকে বলে দেশের জ্ঞানপাপীদের একটা শিক্ষা দিতে হবে। তাদের ভয় দেখাতে হবে। মনসুর কাকা তখনো বুঝে উঠেন নি কি সেই শিক্ষা। মইত্যার দেয়া তালিকা অনুযায়ী বাসা থেকে জ্ঞানপাপীদের ধরে নিয়ে গেছেন। তারপর তাদের পরিণতি দেখেছেন। শিউরে উঠেছেন। প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তান রক্ষা করে ইসলামী ঝান্ডা তুলে ধরতে হলে শত্রুদের এইভাবেই শায়েস্তা করতে হবে এই বলে তাকে বুঝ দেয়া হয়েছে, যদিও মনের মাঝে বরাবরই একটা খচখচ রয়েই যায়। যুদ্ধ শেষ হল। তার মত কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হল, রাঘব বোয়ালগুলো বেঁচে গেল। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিল যে দল, সেই দল রাজাকার পার্টির সাথে আন্দোলনে গেল। যে দলটা একটা সেক্টর কমান্ডারের হাতে গড়া, সেই দল ক্ষমতায় এসে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে প্রেসিডেন্ট বানাল। হা হা হা হা... মনসুর কাকা আপন মনে হেসে উঠেন। কি বিচিত্র!

শুরুর দিকে জেলে এসে মনসুর কাকা করার মত তেমন কিছুই পান না। একসময় জেলখানার জরাজীর্ণ লাইব্রেরীটা তাঁর চোখে পড়ে। বই নেড়েচেড়ে দেখেন। অপরাধীদের সংশোধনের জন্য ধর্মীয় বই এর সংগ্রহ বেশি। তিনি সেসব পড়ে ফেলেন। তাঁর বই পড়াস আগ্রহ দেখে জেলার সাহেব তাঁকে নিজের কিছু ইসলামী বই পড়তে দেন। মনসুর কাকা গোগ্রাসে পড়ে ফেলেন একের পর এক চোখ খুলে দেয়া বই, এতদিনের চেনা ধর্মটাকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। অনুভব করেন - যে ধর্ম শান্তির কথা বলে, শত্রুর প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন যে ধর্মে, সে ধর্ম কিছুতেই ৭১ এর নির্যাতন, ত্রাস সৃষ্টি, হত্যা, ধর্ষণ অনুমোদন করতে পারে না। ইসলামের কথা বলে তার মত অসংখ্য মানুষকে ব্যবহার করা হয়েছে। অবশেষে মনসুর কাকা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। সেই থেকে তিনি আত্মগ্লানিতে ভুগছেন। মাঝে মাঝেই তিনি ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, সবাই আমারে মাফ কইরা দাও, মাফ কইরা দাও, মাফ কইরা দাও! মসজিদে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সেজদায় পড়ে থাকেন। অঝোরে কাঁদেন। কারারক্ষীরা তাঁকে রুমে নিয়ে আসে। তিনি কাঁদতে থাকেন, কিছুতেই থামে না তাঁর কান্না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।

সবুজ তখনো গান গেয়ে চলেছে

যদি বুকটা চিড়ে দেখাতে পারি
কতটা হাহাকার নিয়ে বেঁচে আছি!
কি যে আর্তনাদে একাকার আমি।
একলা স্মৃতির খোলা মাঠে, অন্ধকারের মহাউৎসবে
হারানো দীর্ঘসময়, খুঁজে বেড়াই আমি....
স্মৃতি! সময়! আর কিছু অন্ধকার, আরো ঘোর অন্ধকার।

মনসুর কাকা ডুকরে কেঁদে উঠেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন আমারে তোমরা সবাই মাফ কইরা দাও, মাফ কইরা দাও, মাফ কইরা দাও! সবুজ তার গান থামিয়ে দেয়। সে অভ্যস্ত কাকার এ ব্যাপারটায়। তাই অবাক হয় না। কিন্তু নিজামী অবাক হয়। কৌতূহলী নিজামী মনসুর কাকার সামনে এসে দাঁড়ায়। আরো অবাক হয় মনসুর কাকার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে দেখে।

- বিষয়টা কি? নিজামী প্রশ্ন করে।

মনসুর কাকা প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছেন নিজামীর দিকে। এই সেই লোক যে তাঁকে বিভ্রান্ত করেছিল, ইসলাম রক্ষার নামে অমোচনীয় পাপ করিয়ে নিয়েছিল। ইসলামের লেবাসধারী এইসব ভন্ডরাই ইসলামের প্রধান শত্রু, দেশের শত্রু।

ঘৃণায় মনসুর কাকার গা গুলিয়ে উঠে। তিনি আর পারছেন না। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকা নিজামীর মুখে সমস্ত শক্তি নিয়ে একদলা থুথু মেরে চিৎকার করে বলে উঠেন তুই রাজাকার!

চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত রাজাকারকে দেখে সহজ সরল ছেলে সবুজের চোখেও আগুন জ্বলে উঠে। সে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নিজামীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘৃণাভরে নিজামীর মুখে ছুঁড়ে মারে একদলা থুথু!

মনসুর কাকার সাথে সবুজও বলে উঠল তুই রাজাকার!

[ প্রথম প্রকাশ somewherein ব্লগে ]

গ্রেফতারের পর নিজামী : পর্ব - ৪

সকাল থেকে নিজামী তার টুপি খুঁজে পাচ্ছে না! একি যন্ত্রণায় পড়া গেল! কাকে সন্দেহ করা যায়? নিজামী আসার পর থেকেই বলা নেই কওয়া নেই, তার দিকে হঠাৎ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠা ওই সমবয়সী লোকটাকে? কি নাম যেন লোকটার? ছোকরাটা তো মনসুর কাকা বলেই ডাকে। ছোকরাটার নাম কি? ওহ! সবুজ। মনে পড়েছে। আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না। বয়স হয়ে গেছে, এক পা কবরে। ৭১ থেকে এ পর্যন্ত ইসলামের সেবায়, দেশের সেবায় পুরো জীবন ব্যয় করেও লাভ হল না, শেষ পর্যন্ত জেলের ভাত খেতে হচ্ছে!

ফজরের আযানের সাথে সাথে প্রতিদিন নিজামীর ঘুম ভেঙ্গে গেলেও আজ ঘুম ভাঙ্গে নি। ভাঙ্গল যখন তখন দেখে মনসুর কাকা নামায পড়ছেন। নিজামীকে টুপি খুঁজতে দেখে মনসুর কাকা হাসেন।

- কি ব্যাপার? হাসছেন কেন? আরেকজন বিপদে পড়লে খুশি লাগে? নিজামী প্রশ্ন করে।

- মইত্যা, আর কত ভন্ডামি করবি? মনসুর কাকা ঘৃণাভরে প্রশ্ন করেন।

- মানে? কি আজেবাজে কথা বলছেন? নিজামী স্পষ্টত রেগে উঠে।

- নামায পড়স ভালো কথা। দেশের মানুষের কাছে তোর পাপের লাইগ্যা মাফ চাইছস?

- কিসের পাপ? হুমম? আমাকে শাসানো হচ্ছে? কত্ত বড় সাহস?

- শুন মইত্যা, ইহজীবনে তোর বিচার দেশের মানুষ করতে না পারলেও পরকালে আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবি? মানুষ তোরে মাফ না করলে তো আল্লাহও তোরে মাফ করবো না। কোরান-হাদিস কি পড়ছস? এইটাও জানোস না?

নিজামী কি বলবে ভেবে পায় না। মনসুর কাকা নিজামীর হাত টেনে নিয়ে নিজের টুপিটা হাতে দিয়ে বলেন, ধর টুপি। যা, নামায পইড়া সেজদায় পইড়া আল্লাহর কাছে হেদায়েত চাহ্‌!

অন্যদিকে আমাদের গল্পের সহজ সরল প্রেমিক ছেলে সবুজের ঘুম এই বাকবিতন্ডায় ভেঙ্গে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভাবল টুপি নিয়ে গ্যাঞ্জাম লেগেছে কিনা। চোরের মনে পুলিশ পুলিশ। নিজামীর টুপিটা প্রথম দিনই ভাল লেগেছিল, পছন্দের জিনিস নিজের কালেকশন এ থাকবে না এটা কি করে হয়? তাই গতরাত সুযোগ বুঝে টুপিটা নিয়ে নিজের বালিশের কভারের নিচে ঢুকিয়ে রেখেছে।

নিজামী নামায শেষে তার বিছানায় আবার শুয়ে পড়ে। এবার সবুজ ভয়ে ভয়ে বিছানায় উঠে বসে। টুপি চুরির জন্য তাকে আবার সন্দেহ করছে নাতো! তাকে টুপির জন্য ধরলে কি করা যায়। সে সুযোগ দেয়া যাবে না। আড়চোখে সবুজ নিজামীকে লক্ষ্য করছে। নিজামী তাকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় সে গান শুরু করে দিল-

যদি বুকটা চিড়ে দেখাতে পারি
কতটা হাহাকার নিয়ে বেঁচে আছি!
কি যে আর্তনাদে একাকার আমি।
একলা স্মৃতির খোলা মাঠে, অন্ধকারের মহাউৎসবে
হারানো দীর্ঘসময়, খুঁজে বেড়াই আমি....
স্মৃতি! সময়! আর কিছু অন্ধকার, আরো ঘোর অন্ধকার।

সবুজ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে গাইছে। একি গান বারে বারে। প্রথম দিকে নিজামীর সাথে কথোপকথন এড়ানো গানের উদ্দেশ্য থাকলেও, ভোদাই ছেলেরা যেমন সব কিছুতে প্রেমিকা খুঁজে, তেমনি তারও পুরনো প্রেমিকার কথা মনে পড়ল। গানের প্রতিটি শব্দ যেন তার নিজের মনের কথা বলে দিচ্ছে।

আমাদের মনসুর কাকা তখন জেলরুমের দরজার পাশে দাঁড়ানো। করিডোরের দিকে তাঁর সেই বিখ্যাত শুন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। গানের কথাগুলো যে তার জীবনের সাথেও মিলে গেল!


[ প্রথম প্রকাশ somewherein ব্লগে ]

গ্রেফতারের পর নিজামী : পর্ব – ৩


অপরিচিত কোন জায়গায় এসেই যদি নিজের নামের সাথে অপমানজনক প্রত্যয়যুক্ত কোন সম্বোধন পেতে হয়, তাতে কার না খারাপ লাগে! নিজামীরও লাগল। শুধু তাই না, বেশ বিরক্তও হল। নাহ! দেশের মানুষগুলো আর মানুষ হল না। গুণীজনকে, সম্মানিত লোককে কিভাবে সম্মান দিতে হয়, তার সাথে ব্যবহার কিভাবে করতে হয়, এসব এখনো এদেশের কুশিক্ষিত লোকের শেখা হয় নাই। রবীন্দ্রনাথ মানুষ করার ব্যাপারে কি যেন বলেছিলেন? ধুর! ওই হিন্দু বুইড়াটার কথা মনে পড়ল এই সময়!

মনসুর কাকার দিকে শীতল দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল নিজামী। চোখের ভাষায় সমবয়সী এই লোকটাকে বুঝিয়ে দেয়া খবরদার! বুঝে শুনে কথা বলো! মনসুর কাকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে আছেন নিজামীর দিকে।

রুমের অপর সদস্য সবুজ মজা পাচ্ছে এদের দুজনের কান্ড দেখে। দুই বুড়া এখনি আবার ঝগড়া লাগিয়ে না দেয়। নিজামীর টুপিটা সবুজের পছন্দ হয়েছে। একটু ভিন্ন ধরনের টুপি। আগেও দেখেছে অবশ্য। এই টুপিগুলোর একটা বিশেষ নাম আছে। কি যেন নামটা? মনে আসছে না।

নাহ! শেষ পর্যন্ত খারাপ কিছু হয় নি। নিজামী নিজের বেড এ বসে পড়ে। বড্ড ক্লান্ত। গত রাতে থানায় ছিল। ঠিকমত ঘুম হয়নি। শেষ বয়সে রাত জাগা শরীরে সহ্য হয় না।

রুমের নতুন বাসিন্দাকে অবশ্য সবুজের চেনাচেনা লাগছে। চেনা চেনা লাগে, তবু অচেনা। ভালবাসো যদি, কাছে এসো না। বুড়া মানুষ কাছে এসে কি লাভ? যে আসার কথা ছিল, সেই তো আসলো না। উফ! পুরনো প্রেমিকার কথা আবার মনে পড়ে গেল। প্রায়ই তো দুজন মিলে গানটা গাইতো। সবুজ তো কাছেই এসেছিলো, কিন্তু ততদিনে প্রেমিকা যে আরো দূরে সরে গেছে! সবুজের আবার মনখারাপ হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ বোট্‌কা দুর্গন্ধে সবুজের হুঁশ ফিরে আসে। ব্যাপার কি? আশেপাশে তাকিয়ে আবিষ্কার করে, পাশের বেডে নিজামী গায়ের পাঞ্জাবী খুলে বসে আছে। ঘামের দুর্গন্ধের উৎস ওইখানেই। সবুজ বিরক্ত হয়। তারপরও মুখে কিছু বলে না। বুঝতে পারে গত ২৪ ঘন্টায় নানান ঝামেলায় বেচারার গোসল হয়নি। এই দাড়িওয়ালা সূফি চেহারার মানুষটার ঘটনা কি? কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলে,

- আপনার নাম কি?

- নিজামী। তোমার নাম কি?

- আমার নাম সবুজ। আমি খানিকটা অবুঝ। হেহেহেহে। আপনি কি করেন?

- আমি একজন ইসলামী রাজনীতিবিদ। নিজামী ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দেয়। নাম নিয়ে যুবকের চটুল রসিকতায় খানিকটা বিরক্ত।

- ও আচ্ছা।

নিজামীর জবাবে সবুজের মনে নতুন প্রশ্নের জন্ম হয় যা তাকে পুরনো প্রেমিকার ভাবনা থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও দূরে সরিয়ে রাখে। সে ভাবতে থাকে রাজনীতিবিদের শ্রেণীবিভাগে ইসলামী রাজনীতিবিদদের স্থান আসলে কোথায়? কিন্তু আমাদের গল্পের সহজ সরল ভোদাই ছেলে ভেবে কোন কূল পায় না। অবশেষে জিজ্ঞেস করে ইসলামী রাজনীতিবিদ নিজামীকে,

- আচ্ছা, আপনি হইলেন ইসলামী রাজনীতিবিদ। তাইলে অন্য যারা রাজনীতিবিদ আছেন, তারা কি অনৈসলামিক রাজনীতিবিদ?

- জানি না!

নিজামী যারপরনাই বিরক্ত! অসহ্য! কখন যে তাকে ডিভিশন দেওয়া হবে? একটু আরামে থাকা হবে! এই উঠতি বয়সের পোলাপানের উৎপাত এই শেষ বয়সে সহ্য করতে হচ্ছে!

অন্যদিকে আমাদের মনসুর কাকার ঘোর তখনো কাটে নি। তিনি তার সমস্ত বিস্ময় নিয়ে একটা মানুষের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়-বিহীন বিগত বছরগুলোর নিস্তরঙ্গ জীবন বুঝি শেষ! তাঁর মাথায় এখন রীতিমত ঝড়! একি ব্যাপার! একি অবাক করা ব্যাপার!

রুমে নীরবতার তুমুল উৎসব। হঠাৎ সেই উৎসবে মনসুর কাকার উত্তেজিত কন্ঠ বড্ড বেসুরো হয়ে বেজে উঠে, মইত্যা !!! তোরে আমি পাইছি!


[ প্রথম প্রকাশ somewherein ব্লগে ]

গ্রেফতারের পর নিজামী : পর্ব – ২


ছোট্ট একটা রুম। তিন বেডের। ইংরেজি ইউ-প্যাটার্নে বেডগুলো ফেলা হয়েছে। রুমটা সচরাচর নোংরা হয়ে থাকে। গতকাল সাফসুতরোর কাজ করা হয়েছে। রুমের সদস্যসংখ্যা বর্তমানে ২। রুম হঠাৎ পরিষ্কার হওয়াতে তাদের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। কারাগারের কোণার দিকের এই রুমটাতে আজকে বিশেষ কাউকে আনা হচ্ছে এই ব্যপারটা তাদের অনুমান করতে অসুবিধে হয়নি। বিশেষ ব্যক্তির সাথে একই রুমে বসবাস বিশেষ সুখকর হবে বলে তারা যারপরনাই বিরক্ত।

রুমের ২ বাসিন্দার একজন অল্পবয়সী। নাম সবুজ। নিতান্ত সহজ সরল ভোদাই ছেলে। চট্টগ্রাম শহরের ছেলে। ৬ বছর আগে ঢাকার কোন একটা কলেজে তার পড়তে আসা। একটা মেয়ের সাথে প্রেম। তারপর পালিয়ে যাওয়া। মেয়ের পরিবারের অপহরণ মামলা দায়ের। গ্রেফতার। মেয়ের বিশ্বাসঘাতকতা। ফলাফল ৭ বছরের জেল।

রুমের অপরজনের বয়স কম করে হলেও ৬০। নাম মনসুর আলি। সবুজ ডাকে মনসুর কাকা। সবুজ অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কি কারণে মনসুর কাকার হাজতবাস। মনসুর কাকা বিরক্ত হয় তখন। বলে ধুর! বাদ দাও। এই গল্পে তিনি আমাদেরও মনসুর কাকা।

এখন পা ঝুলিয়ে দুজনই খাটে বসে আছে। মনসুর কাকা করিডোরের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশির ভাগ সময় তিনি এটাই করেন। ফাঁকা দৃষ্টি, শুণ্য দৃষ্টি এইটা কি জিনিস সবুজ মনসুর কাকাকে দেখেই বুঝেছে। সবুজ তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে। একসময় কাকা সেটা খেয়াল করেন। সবুজকে জিজ্ঞেস করেন,

- সবুজ? কি অবস্থা? মন-টন উচাটন?

- কাকা, ভাল্লাগতেছে না।

- কেন্‌?

- কিছু না। এমনি।

- অ...............। বুঝছি। প্রেমিকার কথা মনে পড়ে?

সবুজ চুপ করে থাকে। প্রেম জিনিসটা সবার জন্য না। মনসুর কাকা খোঁচা দেন,

- কি? মেয়ে ভাল লাগে এখনো?

- কাকা চুপ করেন।

- শোনো। কোন মেয়েরে যদি তোমার ভাল লাগে, কিন্তু সে তোমার সাথে টালবাহানা করে, ছলনা করে, তাইলে তারে ভুলার জন্য কি করবা জানো?

- কি করমু? সবুজ মজা পায় কাকার কথায়।

- চোখ বন্ধ কইরা তারে টয়লেটে কল্পনা করবা। ইংলিশ না, বাংলা টয়লেটে। বুঝছো?

সবুজের গা ঘেন্নায় রিরি করে উঠে। এই বৃদ্ধ লোকটা এমনিতে ভাল। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে!

করিডোরের কোলাহলে তারা কথা বন্ধ করে সেদিকে তাকায়। পুলিশ দেখা যাচ্ছে। সাথে একজন বৃদ্ধ লোক। তাদের দুজনেরই ভ্রু কুঁচকে যায়। এই ফিটফাট বৃদ্ধ লোকটাই কি তাদের নতুন রুমমেট?

জেলরুমের তালা খোলা হয়েছে। নিজামী মাথা নিচু করে তার নতুন রুমে ঢুকল। ঢুকে সালাম দেয় পুরনো দুই বাসিন্দাকে। সবুজ বুঝে উঠতে পারে না এই বুইড়া কি আকাম করে এইখানে আসছে!

অন্যদিকে মনসুর কাকার চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছেন নিজামীর দিকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে! চারপাশের ঘটনা নিয়ে তিনি মোটেই আগ্রহী নন। তাই হয়ত খবরটা তাঁর জানা নেই।

মনসুর কাকা মুখ ফসকে বলে উঠেন, মইত্যা, তুই?


[ প্রথম প্রকাশ somewherein ব্লগে ]

গ্রেফতারের পর নিজামী : পর্ব – ১


[ এই গল্পের কাহিনী চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিকপাঠকের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে সাদৃশ্য থাকলে তা নিতান্ত কাকতালীয়।]

একজন প্রবীণ ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছেন। সংক্ষেপে তাঁকে নিজামী নামেই মানুষ চিনে। তাঁর নামের শুরুতে অধ্যাপক আছে কিনা জানা নেই। অবশ্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাঁর বেশ-ভূষায় তাঁকে বেশ জ্ঞানী লোক বলেই মনে হয়। আর somewherein ব্লগের ব্লগার মাইনুল সাহেবের মতে - রাজাকার গোলাম আযম প্রভাষক হিসেবে কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতা করে, অধ্যাপক হবার যোজন যোজন মাইল দূরে থাকলেও, অনেক জ্ঞানী লোক হবার সুবাদে তিনি অধ্যাপক পদমর্যাদার অধিকারী হতেই পারেন! সে হিসেবে নিজামী অধ্যাপক না হয়ে যায়ই না! যাই হোক, আমাদের কাল্পনিক গল্পে নিজামীর অধ্যাপক পদমর্যাদার গুরুত্ব নেই বলেই আশা করছি।

নিজামী - তথাকথিত brain-washed মূর্খ লোকদের মুখে যিনি আলোচিত, নন্দিত; সচেতন মানুষের কাছে সমালোচিত, নিন্দিত, ঘৃণিত। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাঁর গ্রেফতার নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। কখন কি অনাকাঙ্খিত ঘটে যায়!

যাক। অবশেষে গ্রেফতার করা গেছে! তুমুম উত্তেজনা ও হট্টগোলের মাঝে নিজামীকে বুলেট-প্রুফ গাড়িতে উঠানো হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে পেছনের সিটে তাঁর সাথে মাত্র একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বসেছেন! যাই হোক, গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। রাতের নির্জনতা ভেদ করে সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটে চলেছে। অফিসারের হঠাৎ কি বলার প্রয়োজন দেখা দিল। ড্রাইভারকে কানে কানে তিনি কি যেন বললেন। সদ্য বন্দীর সেটা পছন্দ হল না।

বন্দী নিজামী বলল, দেখুন, হাদিসে আছে, তোমরা যদি ৩ জন থাকো, তাহলে একজনকে বাদ দিয়ে বাকি ২ জন গোপনে কথা বলো না। তাই আপনি কাজটা ঠিক করছেন না। যা বলার আমাকেও শুনিয়ে বলুন।

শুনে অফিসারের পিত্তি জ্বলে যায়।

মনে মনে বলল, চুপ থাক বেকুব! কিসের মধ্যে কি! সব জায়গায় ধর্মের দোহাই দেওয়ার অভ্যেস গেল না!

কিন্তু মুখে পাল্টা উত্তর দিল, শুনুন। বুঝে শুনে মাথা খাটিয়ে হাদিস প্রয়োগ করেন। আপনার নামে মামলা হয়েছে। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। রাষ্ট্রের কাছে আপনি এখন একরকম শত্রু বলা চলে। আর শত্রুর সামনে এই হাদিস প্রযোজ্য না। বুঝা গেছে? কমন সেন্স এপ্লাই করেন।

নিজামী চুপসে যায়। কত্ত বড় কথা! কমন সেন্স এর খোঁচা দেওয়া হয়। আরে বেটা, কমন সেন্স এর অভাব থাকলে কি অতীতে আকাম-কুকাম করেও এখন দিব্যি ভাল থাকি! গ্রেফতারের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা....



[ প্রথম প্রকাশ somewherein ব্লগে ]

Saturday, May 24, 2008

একটি সদ্য মুক্ত কাপুরুষের কথা




০১|

নিজেকে কেমন জানি হাল্কা হাল্কা লাগছে। মুক্ত হয়েছি বলেই কি? পুরোপুরি হয়তো না। কিন্তু বহুদিন ধরে বুকের ভেতর চেপে বসা ভারি পাথরটা যে পালিয়েছে সেটা স্পষ্ট টের পাচ্ছি।

একটা প্রাণবন্ত উচ্ছল এবং সময় সময় কিছুটা উদ্দাম সত্ত্বাকে বীভৎসভাবে খুন করে আমি আমার মুক্তি আদায় করে নিয়েছি। অন্য কোন পথ ছিল না আমার। অথচ…

এই সেদিনও আমার একাকিত্বের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলে তুমি! করার মত তেমন কিছু যখন থাকতো না, একাকিত্বে অস্থির লাগতো, কবিতার নামে কিছু ছাইপাশ লিখতাম। পড়ে তুমি বলতে, “বাহ! সুন্দর প্রেমের কবিতা তো! আমার বেশ ভাল লেগেছে।” কবিতার জন্ম দিতাম এই একাকিত্বের যন্ত্রণায় পুড়ে। আর এই অদ্ভূত যুক্তিতে তুমি আমার সাথে হঠাৎ হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে! আমার যে কেমন লাগতো! এইমাত্র ডাঙায় তোলা মাছের মত ছটফট করতাম। ক্লাস করতাম না। দিনে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতাম। ক্লান্ত হয়ে রাতে ভার্সিটির হলে ফিরতাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতাম তুমি যোগাযোগ করার পর কিভাবে তোমাকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। মধ্যরাতে অস্থিরতা কিছুতা কমে এলে টেবিলে বসতাম। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় কবিতার খাতায় খসখস শব্দ তুলে মাথার ভেতর সাপের ফণার মত ছোবল মারতে থাকা শব্দগুলো সাজিয়ে নিতাম।

আমি তোমাকে ডাকতাম ‘তুমি’ বলে, যদিও তোমার নাম ছিল মিতু। ‘ছিল’ বললাম কেন? তুমি অতীত হয়ে গেছো বলেই? আজ সকালেও তুমি আমার কাছে বর্তমান ছিলে। সুবিশাল বর্তমান। আমার জীবন ক্যান্‌ভাসের পুরোটাই তো তুমি ইচ্ছেমত রংতুলি দিয়ে এঁকেছো। তুলির আঁচড় কখনো কখনো ব্যথা দিলেও শিল্পীর সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত মনে করে চুপ থেকেছি।

আমি সেই শিল্পীকে আমার জীবনে বর্তমান থেকে অতীত করে দিয়েছি, খুন করে মুক্তি পেয়েছি!

০২।

তোমার সাথে আমার পরিচয়পর্বটা মোটেই সিনেম্যাটিক নয়। বড়জোর নাটুকে বলা যায়। এখনকার মত মোবাইলের রমরমা অবস্থা তখন ছিল না। “সবার জন্য মোবাইল” প্রকল্প তখনও “জোরেশোরে মহব্বতের সাথে” চালু হয়নি। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরপরই আমি টিউশনিতে লেগে গেলাম। কোচিং সেন্টারগুলোতেও ক্লাস নিতে থাকলাম। আসতে থাকল কাঁচা টাকা। কিনে ফেললাম মুঠোফোন। ভার্সিটির হলে আমার আশেপাশের কয়েকটা রুমে তখন সবেধন নীলমণি এই একখানা মুঠোফোন। সেই মুঠোফোনেই একদিন তুমি কল্‌ করলে। না, আমাকে চাইলে না, চাইলে আমার রুমমেট ও ক্লাসমেট তিতাসকে। পরে তিতাসের কাছেই জানলাম, তোমাদের দুজনের বাড়ি কাছাকাছি। সেই সূত্রেই তোমাদের পূর্বপরিচয়।

আমি নিয়মিত দুপুরে ভাতঘুম দিতাম, উঠতাম সন্ধ্যায়। আর বিকেল বেলাতেই তুমি তিতাসকে দু’তিন দিন পরপর দোকান থেকে কল্‌ করতে। ঘুমের মাঝে মুঠোফোনের আপাত মিষ্টি সুর বিরক্তিকর লাগতো! নাম্বারটা চেনা হয়ে গিয়েছিল। তাই ওই দোকানের নাম্বার থেকে কল্‌ আসলেই আমি সরাসরি তিতাসকে মুঠোফোনটা দিয়ে দিতাম। আর তিতাস ব্যাটা ওটা নিয়ে সোজা চলে যেত বারান্দায়। আমি রুম থেকেই শুনতে পেতাম তার বিগলিত হাসি। ঝাড়া কমপক্ষে ১০ মিনিট স্থায়ী কপোত-কপোতীর কথোপকথন শেষে মুঠোফোনখানা ফেরত পেতাম। বত্রিশ দাঁত বের করে চেহারায় গদগদ ভাব নিয়ে আমার হাতে মুঠোফোনটি গুঁজে দিয়ে তিতাস বলতো, “জয়তু মোবাইল মামু।”

জয় আমার হয়েছে ঠিকই। এক ভিন্ন ধরনের জয়। তো কি হয়েছে? যেভাবেই পাই, জয় জয়ই।

এক বিকেলে যথারীতি তোমার কল্‌ এলো। ঘুম ভেঙ্গে গেল স্বভাবসুলভ বিরক্তি নিয়ে। আশেপাশে তাকাই। রুমে তিতাস নেই। গেল কোথায়? ক্যান্টিনে দুপুরের খাওয়া শেষে টিভি রুমে খেলা দেখতে গিয়ে খেলায় মজে গেল নাকি? কি আর করা! অগত্যা আমিই কল্‌ রিসিভ্‌ করলাম।

- হ্যালো
- তিতু আছে? মানে তিতাস আছে?

বাহ! বাপ-মার দেয়া নামটা প্রেমিকার কাছে এসে লেজ হারিয়েছে! তিতাস থেকে তিতু বানিয়েছে।
আমি উত্তর দিলাম, “তিতাসতো নাই। টিভি রুমে খেলা দেখছে মনে হয়। আপনি দশ মিনিট পর কল্‌ করেন, আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।”

- থাক্‌। ডেকে দিতে হবে না। খেলা দেখছে, দেখুক।

ভদ্রতার মুখোশ পরে বলতে ইচ্ছে করল না, “না না, সমস্যা নেই। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।” বরং কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি ফুটিয়ে বললাম, “ঠিক আছে। আমি তিতাস এলে আপনার কথা বলব।”

আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছি। আবার তোমার কল্‌। আমি রিসিভ্‌ করে তোমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম, “আপনি এক ঘন্টা পর কল্‌ করেন। তিতাস এর মধ্যেই চলে আসবে।”

- আমি ভাবছিলাম আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলব।

পৃথিবীর কোন পুরুষ, হোক সে কাপুরুষ কি প্রকৃত পুরুষ, ঘটনার এমন আকস্মিকতায় অবাক না হয়ে পারে না। আমি তোত্‌লাতে তোত্‌লাতে বললাম, “আ…মা…র সা…থে কথা মানে?”

- আচ্ছা, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করি। আপনি কিন্তু আপনার বন্ধুকে বলবেন না আমি এসব জিজ্ঞেস করেছি।

রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি! আমি আর কিছু না ভেবেই বললাম, “আচ্ছা।”

- সত্যি করে বলুন তো, আপনার বন্ধু তিতাস মানুষ হিসেবে কেমন?
- ভাল
- কতটুকু ভাল?
- যতটুকু ভাল হলে পাশের বাড়ির একটি মেয়ের মনের মানুষ হওয়া যায়।
- সে কি অন্য মেয়েদের সাথেও আপনার মত মেয়ে পটানো টাইপ কথা বলে?

ওরে বাবা! দুই কথাতেই বুঝে গেলে আমি কোন টাইপ্‌ কথা বলি! সাংঘাতিকভাবে আমাকে চমকে দিলে। আমি দমে না গিয়ে তোমাকে বললাম, “কেন? সে বুঝি আপনাকে পটানো টাইপ কথা বলে না?”

তোমার খিল্‌খিল্‌ হাসি। তোমার হাসি শুনে মুগ্ধ হবার মত মনের অবস্থা তখন নেই। আমার কাছে তখন “মেয়ে পটানো টাইপ কথা বলা”র অপবাদটাই মুখ্য। আমি নিরাবেগ গলায় বললাম, “আমি কোন হাসির কথা বলিনি। আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছি।”

- সে আমাকে কি বলে সেটা আপনাকে বলব কেন?
- তাহলে আমিও আপনাকে কিছু বলব না।
- ভালই তো!
- আর কিছু বলবেন?

কয়েক সেকেন্ড কোন কথা নেই। তারপর কিছু না বলেই লাইন কেটে দিলে তুমি। আহ! বাকযুদ্ধে জিতে গেছি!

আমার জয়যাত্রার সেই শুরু।

০৩।

রেডি হতে হতে দেরি হয়ে গেল। ডেটিং এ ফিটফাট হয়ে না গেলে কেমন দেখায়! অমন সুন্দর একটা মুখ তোমার, আমি মুখভর্তি জঞ্জাল নিয়ে হাজির হই কিভাবে?

- সরি, দেরি হয়ে গেল।
- লেইট লতিফ তো দেরি করবেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। বেইলি রোডের এই ফাস্টফুডের দোকানটায় আজ ভীড় কম দেখে স্বস্তি লাগছে।

- খুব বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখলাম নাকি?
- বাদ দাও, এসব সহ্য হয়ে গেছে। চিঠি এনেছো?
- হুম। আমারটা কই?

কয়টা চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে? খুব বেশি না, আবার কমও বলা যায় না। সেসব চিঠি তুমি কোথায় রেখেছো? এসবের জন্য আবার বিপদে পড়ব নাতো! ধুর! পদে পদে বিপদ দেখছি!

‘হয়েছে’ থেকে কখন যে ‘হইছে’ বলতে শুরু করলাম টের পাইনি। অপরিচিতের দেয়াল ভেঙে স্বাভাবিক হতে আমার একটু বেশিই সময় লাগে। তবে তুমি বরাবরই সপ্রতিভ ছিলে।

আমার মনে আছে - একদিন ধানমন্ডি লেকের ৮ নং গেটের ওদিকে বসে আমরা গল্প করছিলাম। হঠাৎ তোমার কি মনে হল জানি না। তুমি তোমার দু’হাত দিয়ে আমার সুন্দর করে যত্ন নিয়ে আঁচড়ানো চুল একেবারে এলোমেলো করে দিলে আর হিহি করে হাসতে থাকলে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এর মানেটা কি?”

- কোন মানে নাই।
- মানে না থাকলে এলোমেলো করে দিছো কেন?
- এলোমেলো করে দিতে ভাল্লাগছে, তাই।

তারপর কাছে এসে হাত দিয়ে আমার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তুমি বললে, “আমি তোমাকে এলোমেলো করে দিবো, আবার নতুন করে সাজাব। সমস্যা কি?” এই বলে আবার তোমার হিহি করে হাসি।

- এত্তো হাইসো নাতো!
- তোমার চুল এত্তো কোঁকড়া কেন্‌!
- সমস্যা কি?
- যাদের চুল কোঁকড়া তাদের একটা ব্যাপার আছে, জানো না?
- না। কি ব্যাপার আছে?
- বলা যাবে না।

আবার হিহি হাসি। এবার কিছুটা রহস্যময়, অশ্লীল ইঙ্গিতবাহী!

হাসলে তোমার দাঁতের মাড়ি দেখা যেত। খাপ-খোলা তলোয়ারের মত ধারাল বা চাঁদের আলোর মত স্নিগ্ধ সৌন্দর্য না থাকলেও তুমি সব মিলিয়ে অপছন্দ করার মত মেয়ে ছিলে না। তবে অপরিচিত কেউ নিশ্চিত ধাক্কা খাবে বেঢপ হাসি দেখে। তুমি হাসার সময় শুধু মুখের নিচের অংশের দিকে তাকালে তোমাকে আমার ডাইনী মনে হতো।

তুমি আসলেই ডাইনী ছিলে!

০৪।

তিতাস খুব মনমরা হয়ে থাকে। ঘটনা কি সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। আমি তো বুঝি। তারপরও না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করি, “কিরে? ঝিম মেরে আছিস কেন্‌?” খানিকক্ষণ চুপ থাকে।

- মিতু মনে হয় আমাকে এড়িয়ে চলছে।
- তো কি হইছে?

তিতাস আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। আমি তাকে সান্ত্বনা দেই, “শোন্‌। যে গেছে সে গেছে। সে তোর ছিল না বলেই চলে গেছে। এখন এতো ভাবাভাবির কি আছে? ভাদাইম্যার মত ঝিম মেরে থাকিস না।”

তিতাস ঝড়ের বেগে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

সান্ত্বনার কথাটা আমি বলে ফেললাম ঠিকই, কিন্তু ভেবে বললাম কি? যে গেছে সে তিতাসের ছিলো না বলেই গেছে। ভালো কথা। তাহলে যে মেয়ে একজনকে এভাবে ছেড়ে আমার কাছে এসেছে, সে যে একইভাবে আমকে ছেড়ে দিয়ে আরেকজনকে ধরবে না তার নিশ্চয়তা কি?

তিতাস রুমে ঢুকে। চোখ ফোলা, লাল হয়ে আছে। মনে মনে ভাবি, “শালা! বিশ্ববিখ্যাত ভোদাই!”। মুখে জিজ্ঞেস করি, “কিরে? কই গেছিলি?”

- টয়লেটে।
- চোখ লাল কেন্‌? আজকাল চোখ দিয়েও টয়লেট করিস নাকি?
তিতাস উত্তর দেয় না।

রাতে ঘুমানোর জন্য শুয়েছি। কিন্তু ঘুম আর আসে না। ভাবনাটা ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছে। পোকার মত কুটকুট করে কামড়াচ্ছে।

যতই দিন যায়, আমার অস্থিরতা ততই বাড়ে। একমুহূর্ত শান্তি পাই না। তোমাকে হারানোর ভয় আমাকে ভয়ংকরভাবে পেয়ে বসে। সারাক্ষণ কেমন যেন একদলা কান্না গলায় এসে আটকে থাকে।

সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। ভয় হতো – কার সাথে এরপর থেকে আমি আমার সুখ-দুঃখের কথাগুলো ভাগাভাগি করব? নাহলে যে শান্তি পাব না! কিন্তু রুমে ফিরেও তো শান্তি পেতাম না। একটাই দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরত – তুমি চলে গেলে কি হবে আমার? সারাক্ষণ বাজে চিন্তা – অন্য কোন ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে নাতো তোমার? নাহ! এভাবে আমার পক্ষে চলা সম্ভব নয়। হারানোর অনিশ্চিত ভয় নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটানোর চেয়ে একাকিত্বের নিশ্চিত যন্ত্রণা হাজারগুণ ভালো।

বহুদিন পর শেষ পর্যন্ত একদিন সফল হয়ে গেলাম! দুলতে থাকা পেন্ডুলামটাকে থামিয়ে দিলাম। খুব একটা কষ্ট তুমি পেয়েছো বলে মনে হয়নি।

০৫।

আমাদের দুজনের সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিলো। প্রাণবন্ত, নদীর পানি যেমন শব্দ তুলে বয়ে যায় তেমনটি। ছোটবেলায় গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটার সময় ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকি পোকাদের আলো দিতে দেখতাম। তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা অসহ্য অন্ধকারে মিটিমিটি আলোর মত ছিলো। যে আলো পথ দেখাতো না, ক্ষণিকের আনন্দ দিতো, আর বাকি পুরোটা সময় মরীচিকার মত বিভ্রান্ত করে যেতো!

[ প্রথম প্রকাশ সচলায়তন এ ]

Wednesday, May 14, 2008

ডিভি লটারি এবং আমেরিকার স্বপ্নীল হাতছানি



ঘুমিয়েছি সকাল ৭ টার দিকে। ঝরঝরে একটা ঘুম দিয়ে উঠলাম দুপুর ২ টার দিকে। ঘুম থেকে উঠেই যে কাজটা করি, মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখি কোন মিসকল আছে কিনা। হুমম, আছে। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে। ব্যাপার কি?

হাত-মুখ ধুয়ে এসে কলব্যাক করলাম। পরিচিত কন্ঠস্বর। বন্ধু আশরাফ।

- কিরে? তোরে ফোন করলাম। ফোন ধরিস না কেন্‌?
- ঘুমাইতেছিলাম। খবর কি তোর?
- খবর ভালই। ডিভি লটারির ফার্স্ট লেটার পাইছি!
- ডিভি পাইছোস! খাইছে! কয়দিন পর উড়াল দিবি?
- প্রসেসিং এর জন্য সময় যতদিন লাগে আর কি।
- সত্যি সত্যি যাবি নাকি?
- হুমম। ওইখানে গিয়ে দেখি কি করতে পারি।
- তোর পড়াশোনাও তো প্রায় শেষের পথে।
- হুমম। ভালই হইছে।
- তো দেশে তোর জমিজমা-সম্পত্তি এইসব দেখবে কে?
- সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবো। আমেরিকায় গেলে পোষায়ে যাবে।
- তুই যা ভাল মনে করিস।

এই হল কথাবার্তার সারকথা। কথা শেষ হবার পর কেমন যেন স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলাম।

আমার বেড়ে ওঠা মফস্বলে। ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিলাম নতুন স্কুলে। স্কুল আবার বাসা থেকে অনেক দূরে। কাজেই হোস্টেলে থাকতে হয়েছিল। দু বছরের হোস্টেল জীবনে আশরাফ ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এরপর আমি ঢাকায় চলে আসি। যোগাযোগ কমে যায়। মুঠোফোনের দয়ায় এখন অবশ্য নিয়মিত যোগাযোগ হয়।

আমার বন্ধুটি প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়ে বাবা-মা দুজনকেই হারায়। বড় একটা বোন আছে, বিয়ে হয়েছে। দুলাভাই সুবিধার না, তক্কে তক্কে আছে সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য। নানার বাড়িতেই সে বড় হয়েছে। পড়াশোনার খরচ মামারা দিত। বাবা-মার সম্পত্তি থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে বাকিটা চলে যায়।

আশরাফ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। স্বভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা বেশি পাগলামো আছে। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় হঠাৎ তার মাথায় টাকা-পয়সা কামানোর ভূত চাপে। আমাকে ফোন করে বলে, “দোস্ত, সৌদি চলে যাব। এতো পড়াশোনা করে কি হবে?”

- মানে? আমি আকাশ থেকে পড়ি।
- চিন্তা করে দেখলাম, সবকিছুর মূলে টাকা। আমার যে যোগ্যতা তাতে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ আমাকে করতে হবে না। লাইন ঠিকমত ধরতে পারলে অন্য ভাল কাজ পেয়ে যাবো। টাকা-পয়সাতো ওখানে ভালই দেয়। পাস করে দেশে আমি কত টাকা বেতনের চাকরি পাবো তুই বল্‌? আর পড়াশোনা করে এখানে সময় নষ্ট করার মানে হয় না!

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো সে ঝেড়ে দেয়। কন্ঠে ক্ষোভের ছাপ স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। উপায় না দেখে তথাকথিত শিক্ষার মূল্য বিষয়ে তাকে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে দেই। তাতে বিশেষ একটা লাভ হয়েছিল বলে মনে হয় না। এর কিছুদিন পর অবশ্য এই ভূত তার মাথা থেকে নেমেছিল।

বস্তুবাদী আর ভোগবাদী এই পৃথিবীতে আমাদের স্বপ্নগুলো যখন টাকা দিয়ে বোনা হয়, টাকার অভাবে যখন আমাদের স্বপ্নগুলো একের পর এক মার খায়, টিউশনির খোঁজে যখন শহর চষে বেড়াতে হয়, মেস খরচ কিভাবে চালাবো সে চিন্তায় অস্থির হতে হয়, তখন ডিভি লটারি প্রাপ্তি খোদার বিশেষ রহমতই বলা চলে। ঠিক বললাম কি?

[ প্রথম প্রকাশিত হয় সচলায়তনে ]

Tuesday, May 13, 2008

ভাবনাগুলো যেমন হয়

আমাদের ভাবনাগুলো সচরাচর এলোমেলো হয়ে থাকে। সেই এলোমেলো ভাবনাগুলো অন্যকে জানানোর ইচ্ছে থেকেই হয়তো ব্লগ এর সৃষ্টি। আমরা ভাবনাগুলোকে যত্নে গুছিয়ে নিই, সাজাই, তারপর পরিবেশন করি।

আমার ভাবনাগুলো আমি সাজাবো না। হাবিজাবি পড়ে যাদের অভ্যাস, তাদের জন্যই আমার লেখা।