Wednesday, June 17, 2009

সিলেট ট্যুর - পর্ব ৬ : মাধবকুন্ড এবং দৃষ্টিসুখকর জলকেলি

বৃহস্পতিবার রাতে ট্রেনের জার্নিতে অনেকেরই ঠিকমত ঘুম হয় নাই। তারপর শুক্রবার সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় দাপাদাপি কইরা আমরা সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। অনেকে আবার রাত জাইগা কার্ড খেলছে। রবিবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাধবকুন্ড যাবার কথা থাকলেও ঘুম থেকে উঠতে দু'একজন ছাড়া সবাই দেরি করছে। নাস্তার সময় কয়েকজনের মুখের অবস্থা দেখে মায়া হইতেছিল।

যাই হোক, আমরা শুরু করলাম আমাদের মাধবকুন্ড যাত্রা। যাওয়ার পথে অনেক মজাই হইছিল। সেসব নোট করে রাখি নাই। ভুইলা গেছি। কারো মনে পড়লে কমেন্ট করিস। মাধবকুন্ডে পৌঁছাইয়া মাইক্রো থেকে নামতেই কিছু ক্ষুদে গাইড পিছু নিল। আদনান আমাদের উদ্ধার করল। সে ক্ষুদে গাইডদের হতাশ করে দিয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে আমাদের গাইড হিসাবে আবির্ভূত হইল। গেটে টিকেট কাইটা ঢুইকা পড়লাম। এইখানে একটা মজার ব্যাপার হইল - আমি কিন্তু টিকেট ছাড়াই ঢুকছি :D অবশ্য অনিচ্ছাকৃতভাবে :-S ঘটনা হইল - মুফতি-শবনম আর আজম আমারে টাকা দিছে টিকেট করার জন্য। আমি টিকেট কিনতে গিয়া নিজের কথা গেছি ভুইলা। ৩ টা টিকেট কিনছি। ওদিকে টিকেট ছাড়াই পোলাপান গেটের ভেতর ঢুইকা গেছে। তারা গেটের মামারে বলছে যে টিকেট কিনা আনতে লোক গেছে। আমি ঢুইকা মামারে দিলাম টিকেট - ৩ টা। মামা জিগায় - বাকি ২ জন কে? আমার তখন মনে পড়ল - আমি নিজের টিকেট কিনতেই ভুইলা গেছি। হায় হায়! কাছেই দেখি মুফতি-শবনম। আমি বললাম - আমি আর এই দুইজন। ততক্ষণে মামা অন্য কিছু লোকের টিকেট চেকিং এ ব্যস্ত। আর আমরা হই হই করতে করতে রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম :-)

পুরা পাহাড়ি পথ দিয়া হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে আমরা পৌঁছাইলাম সেই পাহাড়ি ঝর্ণার কাছাকাছি। অন্য রকম পরিবেশ। সবদিক পাহাড়। পথ বানানো হইছে পাহাড় কাইটা। যেদিকেই তাকাই পাহাড় আর সবুজ। প্রথমেই ফটোসেশন হইল। পাহাড়ি ঝর্ণারে ব্যাকগ্রাউন্ডে রাইখা নিজের একখান ফুটো :D যাদের কাছে ক্যামেরা ছিল তারা বেশ কায়দা কইরা বিভিন্ন এঙ্গেল থেইকা আকাশ, পাহাড়ি ঝর্ণা, পাথর এইসবের ফটো তুলল। পোলাপানের মধ্যে বেশ কিছু চিন্তা করল, তারা পাহাড়ি ঝর্ণার চূড়ায় একটা অভিযান চালাইব। অভিযান শেষে তারা যখন চূড়ায় পৌঁছাইল, তখন নিচ থেকে বেশ কায়দা কইরা তাদের ছবি তোলা হইল। সবার আগে মেহেদিরেই দেখছিলাম চূড়ায়। নিচে থাকা পোলাপাইনের নাম ধইরা চিল্লাইতেছিল।

প্রথম পানিতে নামছিল ... কে আবার? পানির সাথে যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক - সেই তমাল! শুরু থেকেই সে পানিতে নিজেকে ডুবাইয়া রাখল। ক্ষণে এদিক যায়, ক্ষণে ওদিক। আজম নামল। আর নামল এক জুটি - মুফতি আর শবনম। যাই হোক, পাহাড়ি ঝর্ণার ডানদিকে একটা বিশাল পাথর ছিল যেখানে আমরা অনেকেই বসছিলাম। সেইরকম লাগতেছিল তখন। কুয়াশার মত ঝর্ণার পানি আমাদের গায়ে এসে লাগতেছিল। প্রচন্ড গরমের মধ্যে খুব ভাল্লাগতেছিল ।

আমি, ফয়সল আর শান্তনু ছিলাম পোলাপানের ব্যাগের পাহাড়ার দায়িত্বে। ঝর্ণার ঠিক বিপরীত দিকে ছায়া আছে এমন একটা জায়গায় বইসা ছিলাম আর নিজেরা কথা বলতেছিলাম। পরে আমরা কয়েকজন খিদা আর গরমের চোটে তাড়াতাড়ি ব্যাক করছি মাইক্রোতে।

আরো ঘন্টা দুয়েক পর আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। লেবু মামার কাহিনী পরের পর্বে :D

Thursday, June 11, 2009

সিলেট ট্যুর - পর্ব ৫ : হাকালুকি হাওড় এবং জামীর আগাম শ্বশুর বাড়ি বেড়ানো

নীলকন্ঠ চা কেবিনের সাত লেয়ারের চা এর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে আমরা চললাম হাকালুকি হাওড়ের দিকে। মাধবপুর বিল থেকে হাকালুকি হাওড় মোটামুটি দূরে আছে। যদ্দুর মনে পড়ে প্রায় দেড়ঘন্টার মত লাগছে। গরমকালে হাওড়ের পানি অনেকদূর নাইমা যায়। তাই আমরা হাওড়ের কাছাকাছি নামতে পারলাম না। প্রায় ২ মাইলের মত দূরে মাইক্রো থেকে নাইমা হাঁটা দিলাম। তখন বাজে প্রায় ১টা বা ২টার মত। সূর্যের কি তেজ রে বাবা! যারে কয় গনগনে সূর্য, কাঠফাটা রোদ, blazing sun, scorching heat.... যে দিকে হাঁটা দিলাম, সূর্য পড়ল পিঠের দিকে। মনে হইতেছিল পিঠ পুইড়া গেল! পিঠের উপর যেন্‌ চুলা বসাইছে! বাপরে বাপ! তবে আশার কথা হইল ধারে কাছে হাওড় থাকাতে বাতাস ছিল ভাল, বাতাসটাও যেরকম গরম হওয়ার কথা সেরকম ছিল না, অনেকটা ঠান্ডা ছিল। হাঁটতে কষ্ট হইলেও হাঁটা গেছে। হাঁটতে হাঁটতে পথ তো আর শেষ হয় না। কিন্তু কার আগে কে পৌঁছামু এই প্রতিযোগিতা করতে করতে পৌঁছাইয়া গেলাম।

সবার আগে পৌঁছল শান্তনু। তার পরে যারা পৌঁছাইলো তাদের সবাইরে সে বলতে লাগল - হাই, আমি শান্তনু, প্রথম হাকালুকি বিজয়ী :D এরপর পৌঁছল আদনান সহ আরো অনেকে। আদনানের মনে হইল হাকালুকি হাওড়ের পানি পর্যাপ্ত না। মাছদের সমস্যা হইতেছে। তাছাড়া আমরা যারা আসছি তারা এত কম (!) পানি দেখলে হাওড়ের সৌন্দর্য ঠিক উপভোগ করতে পারুম না। সে চুপিসারে আমাদের কাছ থেকে খানিকটা দূরে সইরা গেল। তারপর সে হাকালুকি হাওড়ের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিতে এবং মাছদের জলীয় খাবার সরবরাহে বিশাল অবদান রাখল। ওদিকে কিছু অতি চালাক পোলাপান শর্টকাট মারতে গিয়া আইলের উপর দিয়া আসতেছিল। তাদের বেশির ভাগের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। সবচেয়ে দুর্ভাগা ছিল মেহেদি। বেচারা কাদায় পইড়া গিয়া অবস্থা বেসামাল।

হাকালুকি হাওড়ে আসছি অথচ একটা নৌকাভ্রমণ হইব না? আশে পাশে কোন নৌকা দেখা যাইতেছে না যে ভাড়া করা যায়। কাছাকাছি হাঁটু পানিতে একটা খালি ডিঙি নৌকা পইড়া ছিল। ফয়সল, রিয়াদ আর ২ জন সেই নৌকায় চইড়া বসল। বৈঠা হিসেবে একটা চিক্‌না লাঠি নিয়া ফয়সল নৌকা বাওয়া শুরু করল। হাঁটু পানির মাঝি ফয়সল এরপর আরো অনেকেরেই নৌকাভ্রমণ করাইল। তাদের নৌকাভ্রমণ শেষ হওয়ার আগেই আমি আর আজম ফিরতি পথে হাঁটা দিলাম। যে গরম পড়ছে তাতে আজম ভাইয়ের গামছা মাথার উপর ভাল কাজে দিছে।

ভাল কথা। এই হাকালুকি হাওড়ের আকাশটা ছিল অসাধারণ। অসাধারণ বইলাও আসলে ঠিক বুঝানো যাইব না। পরিষ্কার আকাশী নীল, তার মাঝে সাদা সাদা মেঘ। সেই রকম ছিল। শবনম আর মুফতি এই জায়গায় বেশ কিছু চমৎকার ছবি তুলছে।

পোলাপান হাকালুকি হাওড় থেকে মাইক্রোতে ফিরা ঠান্ডা খাইলো। আমরা যারা আগেভাগে চইলা আসছিলাম তারা মাইক্রোতে এসি ছাইড়া দিয়া বইসা ছিলাম। মাইক্রো যেইখানে রাখা ছিল, তার পাশেই একটা টিউব-ওয়েল পাওয়া গেল। পানি সেইরকম ঠান্ডা! আমরা অনেকেই সেই ঠান্ডা পানি হাত দিয়া খাইলাম। আহ! কি শান্তি! ঠান্ডা পানি খাইয়াও অনেকের হইল না। তারা সবাই গোসল করল সেইখানে। প্রচন্ড গরমের মধ্যে এই রকম ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে কার না ইচ্ছা করে!

হাকালুকি হাওড় থেকে আমরা সিলেট ঢুকলাম। সিলেটের লাল ব্রিজ / কিং ব্রিজ হয়ে আমরা আগে থেকে বুকিং দিয়া রাখা হোটেল হিল টাউনে গেলাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হয় নাই। প্রচন্ড খিদা লাগছে। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে সবাই খাইতে গেলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে এলিন যাইব তার বাসায়। কাছেই। এখন এলিনরে পৌঁছাইয়া দিতে হবে। প্রথমে শুনছিলাম শবনম এলিনরে পৌঁছাইয়া দিবে। আমি হোটেলে ফিইরা দিলাম ঘুম। ঘুম থেকে উইঠা শুনি জামীও নাকি এলিনের বাসায় গেছিল। সাথে ফয়সলও। জিগাইলাম - জামী কি অবস্থা? শ্বশুরবাড়িতে ইন্টারভ্যিউ কেমন হইল? জামী কয় - এই তো দোস্ত, ভাল (চোখে-মুখে হাসি)। শবনম জানাইল - এলিনের আম্মু জামীর আম্মু / আব্বু কেমন আছে জিগাইছে, কিন্তু ফয়সলের আব্বু/আম্মু কেমন আছে সেইটা জিগাই নাই।

বুঝলাম - এলিনের আম্মা মেয়ের জামাই চিনতে ভুল করে নাই। বেচারা ফয়সল... :P

Tuesday, June 9, 2009

সিলেট ট্যুর - পর্ব ৪ : মাধবপুর বিল আর নীলকন্ঠের জঘন্য চা

লাউয়াছড়া বন থেকে আমরা গেলাম মাধবপুর বিল দেখতে। দুপাশে টিলা, পাহাড়ই বলা যায়। মাঝে বিল। বিলের পানি দারুণ স্বচ্ছ আর সেই রকম ঠান্ডা! ঠিক যতটুকু ঠান্ডা হইলে অসম্ভব গরমে গোসল কইরা শান্তি পাওয়া যায়। মাধবপুর বিলে পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে আমরা ১০ টা বাজায়া ফেলছি। সূর্যের তেজ ভালই টের পাওয়া যাইতেছিল। আমার দম ততক্ষণে শেষ! আমি বিলের এক পাড়ে ছায়ায় বইসা পড়লাম। কিছু পোলাপান বিলের বাম পাশের টিলা ধইরা উইঠা গেল। শবনম আর মুফতি বিলের ডানপাশের টিলা ধইরা। আজম ভাবল শবনম আর মুফতি এইভাবে নির্জনে ঘুরব? দুর্ঘটনা ঘইটা যাইতে পারে। তাই সে তাদের কিছু দূরে দূরে থাইকা আগাইতে থাকল। এদের মধ্যে কিছু পোলা ভাবল - এই প্রচন্ড গরমে ছোট ছোট পাহাড়ি গাছগুলা পানির অভাবে খুব কষ্ট পাইতেছে। তাই তারা গাছগুলারে পানি খাওয়াইয়া দোজাহানের অশেষ নেকি হাসিল করিল।

ঘন্টাখানেক ধইরা ঘুরাঘুরি কইরা সবাই মাইক্রোতে ফিরল। মাইক্রোতে যার যা কিছু ছিল তাই নিয়া ছুটল বিলের দিকে গোসল করতে। গোসল শেষ কইরা ফিরতে ফিরতে আরো এক ঘন্টা।

এরপর আমরা গেলাম নীলকন্ঠ টি কেবিন এ চা খাইতে। এই জায়গা নাকি বিশেষ ধরনের চা এর জন্য বিখ্যাত। মফস্বলের রেস্টুরেন্টের মতই একটা জায়গা। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিখ্যাত চা এর আবিষ্কারকের ছবি - একটা টেবিলে তার আবিষ্কার করা বিভিন্ন রকম চা সাজানো, আবিষ্কারক খাটের কিনারায় পা নামাইয়া বসা। এই ছবির নিচে তার মোবাইল নাম্বার, আদি নিবাস, বর্তমান নিবাস ইত্যাদি দেওয়া। আরেক দেয়ালে চোখে পড়ল দোকানের লম্বা একটা মেনু পেইন্ট করা। নরমাল চা থেকে শুরু কইরা গ্রিন টিও আছে। আর রঙ/লেয়ার ২ থেকে শুরু কইরা ৭ পর্যন্ত আছে। প্রতিটা লেয়ারে ১০ টাকা করে দাম বাড়ছে। পোলাপান বেশির ভাগ ভাবল খামু যখন লেটেস্ট/বেশিটাই খাই। দু/একজন পাঁচ লেয়ার আর বাকিরা সাত লেয়ারের চা অর্ডার দিল।

চা বানানোর রুম পাশেই। রুমের দরজার পাশেই লিখা - বিনা অনুমতিতে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। শুনা গেল এই লোক নাকি কাউরে চা বানানোর গোপন পদ্ধতি শিখায় না। আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। অপেক্ষা আর শেষ হয় না। প্রায় আধঘন্টা পর চা আসল। আমরা সাত লেয়ারের চা দেইখা যারপরনাই বিমোহিত। বারবার লেয়ার গুনলাম আসলেই লেয়ার কয়টা দেখার জন্য। যাদের হাতে ক্যামেরা ছিল তার বেশ কায়দা কইরা ছবি তুলল। এই চা খাইয়া ভাব নিতে হবে না‍!

চা এ প্রথম চুমুক কে দিছিল খেয়াল নাই। তবে চুমুক দিয়াই যে শব্দ উচ্চারণ করছিল সেটা খেয়াল আছে - জঘন্য! আমরা তো মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। কী ব্যাপার? ঘটনা কী? বাকিরা তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক দিল এবং যথারীতি বিভিন্ন কুৎসিত শব্দ উচ্চারণ করল - ওয়াক্‌, শিট্‌ ইত্যাদি। তারপর এই চায়ের গুনগান(!) গাওয়া হইল কিছুক্ষণ। এই একটা চা খাওয়ার জন্য যখন এতদূর আসছি, তখন খাইয়াই যামু আর কোন লেয়ার এ কি স্বাদ আছে দেখি - মনে মনে এই বইলা সবাই খাওয়া শেষ করল। খাওয়া শেষেও কারো কোন মতের পরিবর্তন হইল না।

চা খাওয়া শেষে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হইল - এই চা যে আরেকবার খাওয়ার জন্য আসব সে একটা বিশাল বোকাচোদা !

সিলেট ট্যুর - পর্ব ৩ : লাউয়াছড়া বন

ভোর ৬ টার দিকে আমরা লাউয়াছড়া বনের দিকে রওনা দিলাম ২ টা মাইক্রোতে কইরা। একটা মাইক্রো কালা, আরেকটা ধলা। কালাটাতে ঢুকল বিড়িখোর আর বিড়ির-গন্ধ-ভাল্লাগে পোলাপান। ধলাটাতে ঢুকল একটা কুলাঙ্গার পোলা - তমাল, ২ টা সুশীল পোলা - আজম, আমি আর ২ জোড়া অশ্লীল পোলামাইয়া - জামী, এলিন, মুফতি, শবনম। একদম পেছনের সিটে তমাল, মুফতি, শবনম। তমাল এট্টু মোটাসোটা। এটা অশ্লীল জুটির লাইগা শাপে বর। তারা আরো চাপাচাপি কইরা বসল। দুইজনেই ছোট্ট-খাট্ট মানুষ। পারলে মুফতির কোলে শবনম চইড়া বসে :P ঢলাঢলি করতে কার না ভাল্লাগে :D তমালের সামনের সিটে আজম, জামী আর এলিন। জামী-এলিন দুইজনেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। লম্বা চওড়া। ছোট্ট সিটে তাদের হয় না। তারা তাই ক্ষান্ত দিসে। পুরা ট্যুরে সিটপ্ল্যান ছিল এরকমই। জামীর পাশের সিট আর ড্রাইভারের পাশের সিট আমি আর আজম অদল-বদল কইরা বসছি।

আধঘন্টার মধ্যে আমরা বনে পৌঁছাইয়া গেলাম। বনের সৌন্দর্যের বর্ণনা আমারে দিয়া হইব না। এর জন্য লাগব বিভূতিভূষণ ভাইরে। বনের ভিত্রে দিয়া যাইতেছিলাম আমি। চারদিক চুপচাপ। শান্ত, নির্জন। পাখির ডাক। তাদের টয়লেট চাপছে নিশ্চিত। টয়লেট এ লাইন দিছে আর ভিত্রেরটারে বাইর করার লাইগা চিল্লাইতেছে। বিভূতিভুষণ ভাই খালি পায়ে হাঁটছিল বইলা পায়ের নিচে পিষ্ট পাতার ভাইঙা পড়ার শব্দ শুনছিল। আমি বাটা সু পইড়া ছিলাম বইলা হয়ত পাতার মর্মর ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয় নাই। যাই হোক। এত ঘন সবুজ বহুত দিন পরে দেইখা খুব খুব ভাল্লাগছে। লেবু গাছের পাতা ছিঁড়া তার ঘ্রাণ নিছি। সেই ঘ্রাণে মাথাটা কেমন জানি ঝম-ঝম কইরা উঠল! আমি আর শান্তনু অনেক খুঁজাখুঁজি কইরা একটা স্বাস্থ্যবান লেবু গাছ থেকে ছিঁড়া নিয়া আসছি। প্রকৃতির মাঝে আমাদের ফটোসেশনও হইল। মাঝে মাঝে আমরা রাস্তাও হারাইয়া ফেলছিলাম। পরে ডেড-এন্ড দেইখা ফেরত আসছি। পথ দিয়া হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মাথার উপর আচমকা কি জানি একটা ভাইঙা পড়ার শব্দ হইল জোরে! আমি দিলাম ভোঁ-দৌড় সামনের দিকে। পেছনে তাকাইয়া দেখি যেইখানে ছিলাম ওইখানে পড়ছে পচা কাঁঠালের মত একটা জিনিস। আল্লাহ বাঁচাইছে। লাউয়াছড়ার গহীন বনে মেধাবী হইয়া যাই নাই।

বনের ভিতর দিয়া গেছে রেললাইন। রেললাইনের পাশে আমগাছ দেইখা কারো কারো মাথা খারাপ হওয়ার দশা! চিল্লাচিল্লি। গার্ডরা দূর থেকে চিল্লাইয়া আমাদের সাবধান কইরা দেয় - বনের ভিতরে চিল্লাচিল্লি করা যাইব না। রুবেলরে আমরা কিছুতেই থামাইতে পারতেছিলাম না। সে একটা আমরে টার্গেট করছে। সে ওইটা পাইড়াই ছাড়ব। রবার্ট ব্রুস ৭ বারের চেষ্টায় পারছিল। আমাদের রুবেল পারল ২০ বারের মত চেষ্টা কইরা। আম পাড়ার সময় রুবেলরে অনেকে ডাক দিছে - রুবেল ক্ষান্ত দে। আম পাড়ার পর তারা রুবেলরে কয় - রুবেল তোর হাতে ওইটা কিরে? দেখি দেখি...

[ এই জায়গায় আরো মজা হইছিল। সব মনে পড়তেছে না। এই জায়গার কথা মনে পড়লেই খালি সবুজ আর সবুজ চোখের সামনে ভাইসা উঠে। মজার কোন ঘটনা থাকলে কমেন্টে বলিস। ]

Monday, June 8, 2009

সিলেট ট্যুর - পর্ব ২ : মন মাতানো গানের আসর

সময়মত ট্রেন ছাড়ল। কেউ সিটে বইসা আছে, কেউ দাঁড়াইয়া আছে। এর মধ্যে শবনম আর এলিন পাশাপাশি সিটে বসে ছবি তুলল যাতে বাসায় গিয়া দেখানো যায় যে তারা ট্রেনে সুযোগ পাইয়াও প্রেমিকের সাথে রাত কাটায় নাই এবং তারা কত্ত ভালো! বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পর দেখা গেল এলিন তার ব্যাগ থেকে যত্নে বানানো পরম মমতা মাখানো খাবার বের করে জামির (লম্বা) হাতে তুলে দিল। এলিন আর জামির বিয়ের পর তাদের বাসায় দাওয়াত খাইতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিনা এইটা যাচাই করার জন্যে আমি সেই খাবার একটু টেস্ট কইরা দেখলাম। জামির খাবারে ভাগ বসানোতে এলিন মনে হইল একটু মাইন্ড খাইলো! আমার সামনের দু'সিটে মুফতি আর শবনম। আমি আর ফয়সল তাদের পেছনে বসে তাদের প্রেম-পূর্ণ কথা-বার্তায় ব্যাঘাত ঘটাইতেছি খানিকটা ...

কিছুক্ষণ পর পোলাপান আজাদের নেতৃত্বে গান গাওয়া শুরু করল। পোলাপানের সুপ্ত গায়কি প্রতিভার তীব্র বিচ্ছুরণ ঘটল! সেই বিচ্ছুরিত আলো অনুসরণ কইরা ট্রেন মাস্টার আমাদের বগিতে আসলেন এবং আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে ট্রেনের অন্য যাত্রীরা আমাদের সুললিত কন্ঠের প্রেমে পড়তে পারে এবং এতে করে তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। মনে হইল তিনি আমাদের শব্দ না করে গান গাওয়ার অনুরোধ করতেছিলেন যার কারণে রুবেল তীব্র অভিমানী গলায় বইলা উঠল - ট্রেনের আওয়াজ তো আমাদের গানের চেয়েও বেশি! একদল বিচ্ছু পোলাপানের সাথে কথা না বাড়াইয়া বুদ্ধিমানের মত উনি সোজা হাঁটা ধরলেন।

আমাদের পারফরম্যান্স সেইরকম হইতেছিল। তার প্রমাণ - কিছুক্ষণ পর সামনের সিটের এক আন্টি আমাদের song request করলেন। আরো কিছু গানের অনুরোধ আসলো। আমরা তাদের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। আমাদের পারফরম্যান্স আরো ভাল হচ্ছিল। গান খুব ভাল গাইলে যা হয় আর কি! দর্শক-শ্রোতারাও গলা মেলায়। আমাদের সেই আন্টিও প্রচন্ড উৎসাহে আমাদের সাথে গলা মিলাইলো। হঠাৎ রাত দেড়টার দিকে আজম মামার মোবাইলে আজান হইল। আজম খুব ধার্মিক পুরুষ। সে সাথে সাথে চোখ বন্ধ কইরা গভীর ধ্যানের সাথে মোবাইলে ইবাদত শুরু করল। এতকিছুর মধ্যেও দুটা পোলা ছিল চুপচাপ। একটা হইল ফয়সল, আরেকটা তমাল। ফয়সলরে দেখলাম মোবাইলে গান শুনতাছে আর তমাল চোখের উপর রুমাল দিয়া ঘুমাইতেছে।

এইভাবে আমরা ট্রেনের যাত্রীদের মনোরঞ্জন করতে করতে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্য শ্রীমঙ্গল এ। ৪টা বাজে। এতভোরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কাজ নাই। অনেকের খিদাও পাইছে। শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে বের হইয়াই ২/১ টা খাবারের দোকান চোখে পড়ল। আমরা ঢুকলাম। পরোটা-ভাজি-ডিম-চা এইসব খাইলাম। সাথে সাথে আড্ডাও চলতে থাকল। প্রসঙ্গক্রমে সেই আন্টির কথা উঠল। শবনম সেই মহিলাকে আন্টি ডাকায় মাইন্ড খাইল। তার মতে উনাকে বড়জোর আপা বলা যায়। স্বাভাবিক। ৪০ ছুঁই ছুঁই একটা মহিলাকে আপা ডাকলে শবনম হয়তো আরো কনফিডেন্স পায় :P আরেকজন বলল - একবার ক্লাস থ্রি এর এক বাচ্চা পোলা তারে আংকেল ডাকছিল। আমি যুক্তি দিয়া বুঝানোর চেষ্টা করলাম - ক্লাস থ্রি'র ওই বাচ্চার সাথে আমাদের বয়সের পার্থক্য ১৫ বছরের মত। আর ওই মহিলার বয়সও আমাদের চেয়ে অন্তত ১৫ বছর বেশি। তাইলে তারে আমরা আন্টি ডাকতেই পারি। আরেকজন আবার সুবিধাবাদী একটা মতামত দিল। ওই মহিলার যে মেয়ে ছিল তারে যার পছন্দ হয় সে আন্টি ডাকব, বাকিরা আপা।

বোমা ফাটাইল তমাল! সে একটা ভিজিটিং কার্ড বাইর কইরা বলল - আন্টি মডার্ন হুজুরাইন, "এসো কোরআন শিখি" নামের একটা প্রতিষ্ঠানের পরিচালিকা। আমরা কয়েকজন উৎসাহ নিয়া সেই কার্ডে চোখ বুলাইলাম। তমাল এই কার্ড পাইল কই? তমালরে নাকি আন্টি দিছে। তারে ক্যান দিল? তমালের উত্তর - "আমাকে reliable মনে হইছে, তাই দিছে। তোদেরকে হয়তো মনে হয় নাই।" পোলার কথা শুনছো! তুই বেটাই কি শুধু ইয়ে ব্যবহার করিস? আমি জিগাইলাম - তুই চোখের উপর রুমাল দিয়া ঘুমাইছোস আর তাতেই প্রমাণ হইল যে you believe in protection? তমাল হাসে... আমরাও হাসি :D

সিলেট ট্যুর - পর্ব ১ : এডভেঞ্চারের শুরুটা এখানেই!

ভ্রমণের সাথে এডভেঞ্চারের যোগসূত্র আছে কি নাই এইটা নিয়া দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু "নিরুদ্বিগ্ন প্রশান্ত মনে প্রকৃতি-দর্শন" এর সাথে শুরুর এডভেঞ্চারের মসলা যোগে সিলেট ট্যুর খানা ষোল আনাই স্বাদু হইয়াছে :-D

অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল প্রায় শেষ হয় হয়। জিনিস-পত্র গোছ-গাছ এখনো বাকি। সুন্দরবন ট্যুরের ঠিক আগে বি.ডি.আর. এর গোলাগুলির দিন নিউ মার্কেট থেকে কেনা ব্যাগটা আছে বলে রক্ষা। প্রস্তুতি বলতে ওই টুকুই। কি কি নিতে হবে ১৫ মিনিট ধরে তার লিস্ট করলাম। তারপর সব বিছানার উপর রাখলাম। তারপর কোন জিনিস ব্যাগের কোন চেইনে রাখব, সেইটা ভাবতে ভাবতে আরো কিছুক্ষণ। আরো ১০ মিনিট লাগাইয়া ব্যাগে জিনিস-পত্র ঢুকাইলাম। সবকিছু ঠিকঠাক। যেই রুমের বাইরে পা রাখতে যামু, অমনি কারেন্ট গেল চইলা! কিছুদিন আগে কেনা সস্তা নকিয়া মোবাইলের টর্চই সম্বল। কাঁধে বিশাল ব্যাগ, এক হাতে মোবাইল নিয়া আরেক হাত দিয়া যেই মূল দরজার তালার একটা ব্যবস্থা করতেছি, অমনি মোবাইলখানা ঠাস করে ফ্লোরে গেল পইড়া! ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া তিন টুকরা খুঁইজা পাইলাম - মূল ফ্রেম, ব্যাটারি আর ব্যাক-কাভার। যাক, বাঁচা গেল!

হাতে সময় আছে দু'ঘন্টার কিছু বেশি। কমলাপুর গিয়া খানিকটা পেট-পূজা না করলে পেটের ভিতরে ঘুমাইয়া থাকা অগ্নি-দেবতা জাইগা উইঠা জ্বালাইয়া দাও পুড়াইয়া দাও শ্লোগান তুলতে পারে। ট্রেনের খাবারের মান তো যাচ্ছেতাই। স্টেশনের কাছকাছি ভাল একটা রেস্টুরেন্ট আছে - দারুচিনি রেস্টুরেন্ট। ওইখানেই খাব। বাসে করে কমলাপুর গেলে খাওয়ার সময় পাবো কিনা সন্দেহ আছে। অগত্যা সি.এন.জি. । ৩০ মিনিট ধরে সি.এন.জি. ড্রাইভারদের ভার্চুয়ালি হাত-পা ধইরাও কাজ হইতেছিল না। শেষমেষ এক ড্রাইভার দয়া কইরা যাইতে রাজি হইল - ২০০ টাকায়! মোহাম্মদপুর থেকে কমলাপুর! আমি "শতভাগ হতবাক" হইয়াও উইঠা পড়লাম। কিছু করার নাই।

কমলাপুরের কাছাকাছি আসতেই আমার মোবাইলের টুকরাগুলা মোবাইল প্যান্টের পকেট থেকে বাইর করলাম। জোড়া দিয়া যেই স্টার্ট দিতে যাব, দেখি মোবাইলের কি-প্যাড নাই! হায় হায়! কারো নাম্বার তো আমার মুখস্ত নাই। কেমনে যোগাযোগ করবো এই চিন্তায় আমি অস্থির। রেল স্টেশনের এক প্লাটফর্ম থেকে আরেক প্লাটফর্মে আমি দৌড়াইতেছি। চেঁচাইতেছি একেক জনের নাম ধরে। কিন্তু কেউ শুনতেছে না। কাউরে পাইতেছি না। হঠাৎ দেখি একটা ট্রেন চলতে শুরু করছে। ট্রেনের নাম কি দেখার চেষ্টা করতেছি। ওই তো! ওইতো উপবন এক্সপ্রেস! আমি দৌড়াইতেছি। দৌড়াইতেছি। কিন্তু না... হইল না। আমি উঠতে পারলাম না... এমন দৃশ্য চোখের সামনে ভাইসা উঠল। কমলাপুরে মোবাইল ঠিক করার দোকান-টোকান আছে কি নাই কে জানে! ভাড়া মিটাইয়া তাড়াতাড়ি গিয়ে দাঁড়াইলাম ট্রেন ছাড়ার লিস্ট এর সামনে। যদিও ফয়সল বলছে ট্রেন ছাড়বে ৯ টা ৪০ মিনিটে, লিস্টে দেখলাম ১০ টায়। স্টেশনের বেশ কয়েকটা প্লাটফর্ম। প্রত্যেকটাতে গিয়া ছুটাছুটি করলাম পরিচিত কোন মুখ দেখার আশায়। কেউই এখনো আসে নাই। গার্ডদের জিজ্ঞেস করলাম উপবন এক্সপ্রেসটা কোন প্লাটফর্ম থেকে ছাড়ে। বলল - ঠিক নাই। ৯ টা তো বেজে গেছে। টেনশনে ঘামে গোসল হয়ে গেছে। স্টেশনের সামনের দিকটায় হাঁটাহাঁটি করতেছি। কাউরেই দেখি না। আল্লাহ আল্লাহ করতেছি। একবার স্টেশনের ওই মাথায় যাই, আরেকবার এই মাথায়। ক্যান্টিনগুলাতে গিয়া উঁকি মেরে দেখি পোলাপান কেউ খাইতেছে কিনা। দূর থেকে ৩/৪ জনের জটলা দেখলেই কাছে আগাইয়া গিয়া দেখি আমাদের কেউ কিনা। ডাচ-বাংলা ব্যাঙ্কের এ.টি.এম. বুথের সামনে গিয়া দেখি আমাদের কাউরে পাওয়া যায় কিনা - সিলেট রওনা দেওয়ার আগে টাকা তুলতেই পারে। ধুর! এত কষ্ট করে আসছি। এখন যদি মিস করি! চিন্তা করলাম - ট্রেন মিস করলে কি করা যায়... ক্যান যে একটা ফোনবুক টাইপের জিনিস হাতের কাছে রাখি না! মেজাজ খারাপ হইতেছে! হঠাৎ দেখি - ডাচ-বাংলা ব্যাঙ্কের এ.টি.এম. বুথের সামনে আজম মামা দাঁড়াইয়া আছে আর আমারে ডাকতেছে! আমি তো উত্তেজনায় আর আনন্দে... !!! দৌড়াইয়া গিয়া জড়াইয়া ধরলাম :)

তারপর দু'জন একসাথে খুঁজতে গেলাম মোবাইল ঠিক করার দোকান। ভাগ্য ভাল - পাইয়া গেছি। তারপর রাতের খাবার খাইলাম দারুচিনি রেস্টুরেন্টে। পেট ভরে খাইছি। বিকেলে নাস্তা করি নাই। চরম খিদা পাইছিল।

স্টেশনে ফিরা দেখি অনেকেই চলে আসছে। অভিযাত্রী আর "হইতে চাইছিলাম-হইতে পারি নাই" মডেলদের কিছুক্ষণ ফটোসেশন হইল। তারপর সবাই মিইলা হই-হই করতে করতে স্টেশনের ভিতরে ঢুকলাম।