Wednesday, May 14, 2008

ডিভি লটারি এবং আমেরিকার স্বপ্নীল হাতছানি



ঘুমিয়েছি সকাল ৭ টার দিকে। ঝরঝরে একটা ঘুম দিয়ে উঠলাম দুপুর ২ টার দিকে। ঘুম থেকে উঠেই যে কাজটা করি, মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখি কোন মিসকল আছে কিনা। হুমম, আছে। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে। ব্যাপার কি?

হাত-মুখ ধুয়ে এসে কলব্যাক করলাম। পরিচিত কন্ঠস্বর। বন্ধু আশরাফ।

- কিরে? তোরে ফোন করলাম। ফোন ধরিস না কেন্‌?
- ঘুমাইতেছিলাম। খবর কি তোর?
- খবর ভালই। ডিভি লটারির ফার্স্ট লেটার পাইছি!
- ডিভি পাইছোস! খাইছে! কয়দিন পর উড়াল দিবি?
- প্রসেসিং এর জন্য সময় যতদিন লাগে আর কি।
- সত্যি সত্যি যাবি নাকি?
- হুমম। ওইখানে গিয়ে দেখি কি করতে পারি।
- তোর পড়াশোনাও তো প্রায় শেষের পথে।
- হুমম। ভালই হইছে।
- তো দেশে তোর জমিজমা-সম্পত্তি এইসব দেখবে কে?
- সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবো। আমেরিকায় গেলে পোষায়ে যাবে।
- তুই যা ভাল মনে করিস।

এই হল কথাবার্তার সারকথা। কথা শেষ হবার পর কেমন যেন স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলাম।

আমার বেড়ে ওঠা মফস্বলে। ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিলাম নতুন স্কুলে। স্কুল আবার বাসা থেকে অনেক দূরে। কাজেই হোস্টেলে থাকতে হয়েছিল। দু বছরের হোস্টেল জীবনে আশরাফ ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এরপর আমি ঢাকায় চলে আসি। যোগাযোগ কমে যায়। মুঠোফোনের দয়ায় এখন অবশ্য নিয়মিত যোগাযোগ হয়।

আমার বন্ধুটি প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়ে বাবা-মা দুজনকেই হারায়। বড় একটা বোন আছে, বিয়ে হয়েছে। দুলাভাই সুবিধার না, তক্কে তক্কে আছে সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য। নানার বাড়িতেই সে বড় হয়েছে। পড়াশোনার খরচ মামারা দিত। বাবা-মার সম্পত্তি থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে বাকিটা চলে যায়।

আশরাফ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। স্বভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা বেশি পাগলামো আছে। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় হঠাৎ তার মাথায় টাকা-পয়সা কামানোর ভূত চাপে। আমাকে ফোন করে বলে, “দোস্ত, সৌদি চলে যাব। এতো পড়াশোনা করে কি হবে?”

- মানে? আমি আকাশ থেকে পড়ি।
- চিন্তা করে দেখলাম, সবকিছুর মূলে টাকা। আমার যে যোগ্যতা তাতে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ আমাকে করতে হবে না। লাইন ঠিকমত ধরতে পারলে অন্য ভাল কাজ পেয়ে যাবো। টাকা-পয়সাতো ওখানে ভালই দেয়। পাস করে দেশে আমি কত টাকা বেতনের চাকরি পাবো তুই বল্‌? আর পড়াশোনা করে এখানে সময় নষ্ট করার মানে হয় না!

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো সে ঝেড়ে দেয়। কন্ঠে ক্ষোভের ছাপ স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। উপায় না দেখে তথাকথিত শিক্ষার মূল্য বিষয়ে তাকে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে দেই। তাতে বিশেষ একটা লাভ হয়েছিল বলে মনে হয় না। এর কিছুদিন পর অবশ্য এই ভূত তার মাথা থেকে নেমেছিল।

বস্তুবাদী আর ভোগবাদী এই পৃথিবীতে আমাদের স্বপ্নগুলো যখন টাকা দিয়ে বোনা হয়, টাকার অভাবে যখন আমাদের স্বপ্নগুলো একের পর এক মার খায়, টিউশনির খোঁজে যখন শহর চষে বেড়াতে হয়, মেস খরচ কিভাবে চালাবো সে চিন্তায় অস্থির হতে হয়, তখন ডিভি লটারি প্রাপ্তি খোদার বিশেষ রহমতই বলা চলে। ঠিক বললাম কি?

[ প্রথম প্রকাশিত হয় সচলায়তনে ]

No comments: